সাধারণত ক্রিসমাসের সময় শুরু হয় বলে নামটি এ রকম। ‘লা নিনা’ নামেও আরেকটি স্প্যানিশ শব্দ রয়েছে, যার অর্থ ‘ছোট্ট মেয়ে’। নামকরণ যেমনই হোক, পরিবেশ বিপর্যয়কারী হিসেবে পরিচিত এল নিনো ও লা নিনা বন্যা, খরাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে আসে।
আসন্ন এল নিনোকে ‘গডজিলা এল নিনো’ ও ‘ব্রুস লি এল নিনো’ নাম দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। অন্যান্য সময়ের চেয়ে এবারের এল নিনোকে দীর্ঘমেয়াদি ও ধ্বংসাত্মক রূপে দেখা যাবে বলে এমন নাম দেয়া হয়েছে। এ বছর ভারত, চীন ও আর্জেন্টিনার বন্যা, যুক্তরাষ্ট্র ও পেরুর ঘূর্ণিঝড় এবং জার্মানি, রোমানিয়া ও পোল্যান্ডের দাবদাহকে এল নিনোর লক্ষণ বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা
পেরুর জেলেদের চোখে প্রথম ধরা পড়ে এল নিনো ১৬০০ সালে। এল নিনোর উষ্ণ বিষুবীয় জলস্রোত ঠাণ্ডা বিষুবীয় হাবল্ট স্রোতের সঙ্গে মিশে পরিবর্তন ঘটায়। ফলে অত্যধিক গরম সামুদ্রিক জলরাশির দেখা মেলে। সেই সঙ্গে মাছেরা অদৃশ্য হয়ে যায়। সে সময়েই পেরুর জেলেরা এটা টের পেয়েছিলেন।
ভারত মহাসাগর, অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার উপরিভাগের পানির চাপের পরিবর্তনের সঙ্গে তাহিতিসহ মধ্য-পূর্ব সমুদ্রের বায়ুচাপ কমলে বোঝা যায়, এল নিনো চলছে। একই সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরে গরম বাতাস ও পেরুভিয়ান মরুভূমিতে বৃষ্টি শুরু হলেও এল নিনোকে দায়ী করা হয়। সহজ কথায়, এল নিনো হচ্ছে সাগরের উপরিভাগের পানির তাপমাত্রার এক নিরবচ্ছিন্ন পরিবর্তন।
সাধারণত এটা দুই থেকে সাত বছরের মধ্যে যেকোনো সময় নয় মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে এ দুর্যোগ। এল নিনোর কারণে দক্ষিণ আমেরিকা ও পূর্ব আফ্রিকায় ভারি বৃষ্টিপাত, উচ্চতাপমাত্রা ও ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়। মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় বৃষ্টিপাতের মাত্রা কমে যায়, আবহাওয়া শুষ্ক হতে হতে অতি খরায় রূপ নেয়।
টাইফুন বা হারিকেনের মতো একক কোনো দুর্যোগ নয় এল নিনো, বরং জলবায়ু-সংক্রান্ত গতিবিধি নির্দেশ করে এল নিনো। বিশেষজ্ঞদের মতে, বায়ুমণ্ডলে তাপ বেড়ে যাওয়ার পেছনে এল নিনো কাজ করে। এমনকি গোটা পৃথিবীর আবহাওয়াকেও প্রভাবিত করে এটা। এর প্রভাবে মুদ্রাস্ফীতিও বেড়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। এল নিনোর কারণে কৃষি ও অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। ফলে বাড়তে পারে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইনস্টিটিউটের এক জরিপ বলছে, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোয় গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা দ্বিগুণ করে দিতে পারে এ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এল নিনোর কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। যেমন— এর প্রভাবে বহু অঞ্চলের টর্নেডো ও হারিকেন দুর্বল হয়ে পড়ে।
১৯৫০ সাল থেকে এল নিনোর তথ্য-উপাত্ত রেকর্ড করা হচ্ছে। এর সবচেয়ে বিধ্বংসী অবস্থা দেখা গিয়েছিল ১৯৯৭-৯৮ সালে। তখন বিশ্বের নানা প্রান্তের ২৩ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়, ক্ষয়ক্ষতির অঙ্ক দাঁড়িয়েছিল ৩৬ বিলিয়ন ডলারে। এরও আগে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি ও শেষের দিকে দক্ষিণ আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় খরা বয়ে এনেছিল। জাপান ও ভারতের আবহাওয়া দফতর এবং আমেরিকার ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমস্ফিয়ার অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা এনওএএ সতর্কতা জারি করেছে— এ বছর আবারো দেখা দিতে পারে এল নিনো। তাদের মতে, শীতকালে শুরু হয়ে তা আগামী বছরের জুলাই পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। আসন্ন এল নিনোকে ‘গডজিলা এল নিনো’ ও ‘ব্রুস লি এল নিনো’ নাম দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। অন্যান্য সময়ের চেয়ে এবারের এল নিনোকে দীর্ঘমেয়াদি ও ধবংসাত্মক রূপে দেখা যাবে বলে এমন নাম দেয়া হয়েছে। এ বছর ভারত, চীন ও আর্জেন্টিনার বন্যা, যুক্তরাষ্ট্র ও পেরুর ঘূর্ণিঝড় এবং জার্মানি, রোমানিয়া ও পোল্যান্ডের দাবদাহকে এল নিনোর লক্ষণ বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা।
২০০৯ সালে এর প্রভাবে অস্ট্রেলিয়ায় খরার প্রকোপ দেখা গিয়েছিল। মাঠের ফসল শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়ায় সরবরাহ কমে যায়। এতে বিভিন্ন রকম শস্যের দামও বেড়ে গিয়েছিল তখন। শঙ্কার কথা, এশিয়ার দেশগুলোর বেলায় এ বছর তেমনি অশনিসংকেত নিয়ে আসতে পারে এল নিনো। অসুখ-বিসুখও বয়ে আনে এল নিনো। ১৯৯৭-৯৮ সালের ভারি বৃষ্টিপাত কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়ায় ম্যালেরিয়ার লার্ভাবাহিত মশার প্রকোপ বাড়িয়ে দিয়েছিল। রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ওষুধ, কীটনাশক ও মশারি বিতরণে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল জাতিসংঘের কর্মীদের। আবারো এ দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে আরো কয়েকটি দেশ।
এল নিনো শেষ হওয়ার পর লা নিনা হতে পারে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়। তবে এর ব্যতিক্রমও ঘটতে পারে। অর্থাত্ পর পর এল নিনো সংঘটিত হতে পারে। সংশয়বাদীরা জলবায়ুজনিত এসব পরিবর্তনের জন্য মানুষকে দায়ী করে আসছেন। তাদের ভাষায়, মানুষের শাসনই প্রকৃতিকে খামখেয়ালি করে তুলছে। প্রকৃতিও যেন মানুষকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। বিভিন্ন ঋতুর চিরাচরিত নিয়মে তাই অনেক আগে থেকে এখন অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছে— যেমন শীতের সময় গরম। এরই মধ্যে আবহাওয়াবিজ্ঞানের ইতিহাসে উষ্ণতম বছর ২০১৪ প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী। এর কারণ এল নিনো। গত বছরের চেয়ে ভিন্নরূপে ফিরে আসতে পারে এ বছরের এল নিনো।
0 Reviews:
Post Your Review