তুরস্কের সমুদ্র সৈকতে তিন বছরের এক
শরণার্থী শিশুর লাশ পাওয়ার পর পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রবল হইচই শুরু হয়েছে। আয়লান কুর্দি নামের এই শিশুর পরিবারটি তুরস্ক থেকে গ্রিস যাওয়ার জন্য নৌকায় উঠেছিল। নৌকাডুবিতে শিশুটির বাবা ছাড়া আর সবাই মারা যায়। সিরিয়া, লিবিয়া ও ইরাকের শরণার্থীদের এভাবে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে দেশত্যাগের সময় কয়েক হাজার মানুষ মারা গেছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার (আইওএম) হিসাব মতে, চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরে এক হাজার ৭২৭ জন মারা গেছে। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা ছিল তিন হাজার ২৭৯ জন। ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়া এই মানুষদের মধ্যে বেশির ভাগ ছিল নারী ও শিশু। বহু আয়লান কুর্দি সমুদ্রে ভেসে গেছে, কিন্তু তার খবর হয়নি।আইওএম আশঙ্কা করছে, এ বছর ভূমধ্যসাগরে কমপক্ষে ৩০ হাজার মানুষ এভাবে ডুবে মারা যাবে।নির্যাতিত মানুষ কিভাবে বেঁচে থাকার জন্য সাগর পাড়ি দেয়, সে দৃশ্য আমরা দেখেছি এ বছরের এপ্রিল-মে মাসে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীরা নৌকায় করে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময়। সে সময় বহু রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী মারা গিয়েছিল। মালয়েশিয়া আর থাইল্যান্ডে এখনও পাওয়া যাচ্ছে গণকবর। এর আগে ২০১২ সালে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের বাংলাদেশও আশ্রয় দেয়নি। নৌকায় হাতজোড় করে কান্নায় ভেঙে পড়া নারী-শিশুদের ছবি তখন বিশ্বের গণমাধ্যমে ছাপা হয়েছিল। ইউরোপের বিবেক তখন নাড়া দেয়নি। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার প্রতিশ্রুতি কোনো পশ্চিমা দেশ দেয়নি, বরং ইন্দোনেশিয়ায় আশ্রয় নেয়া কেউ যাতে অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য সমুদ্রপথে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এমনকি লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যারা ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করছে, তাদের জন্য ইউরোপ কোনো দরজা খুলে দেয়নি। কিন্তু তুরস্কের সমুদ্রতীরে শিশুটি মারা যাওয়ার পর হঠাৎ করে ইউরোপীয় দেশগুলোতে এক ধরনের উন্মাদনা লক্ষ করা যাচ্ছে। অবশ্য জার্মানি আগেই ঘোষণা দিয়েছিল, দেশটি এ বছর আট লাখ অভিবাসী নেবে। ইতোমধ্যে সিরিয়াসহ বিভিন্ন আরব দেশের আট লাখ শরণার্থী ইউরোপে পৌঁছে গেছে। ইউরোপের এই বিবেক জাগ্রত হওয়ার কারণ কি শুধুই মানবতার জন্য, নাকি এর পেছনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ কাজ করছে, সেটি এখন বড় প্রশ্ন।
জার্মানিতে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী আশ্রয় দেয়া নিয়ে যখন বিতর্ক তুঙ্গে তখন জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল মন্তব্য করেন We will tell our children that Syrian migrants fled their country to come to Europe when Mecca and Muslim lands were closer to them. আমরা ভবিষ্যতে আমাদের সন্তানদের বলব মক্কা আর মুসলিমরা পাশে থাকার পরও সিরীয় শরণার্থীরা ইউরোপে পালিয়ে এসেছিল। অর্থাৎ মুসলিমদের আশ্রয় দিয়ে তার দেশ যে করুণা করেছে, সে কথা তিনি পরবর্তী প্রজন্মকে জানাবেন। মার্কেলের এই বক্তব্য নিঃসন্দেহে ধনী আরব দেশগুলোর গালে একটি চপেটাঘাত। সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ধনী আরব দেশগুলো একটি পক্ষ হিসেবে ভূমিকা পালন করলেও মানবিক বিপর্যয় ঠেকানোর ক্ষেত্রে তাদের কোনো ভূমিকা লক্ষ করা যাচ্ছে না। কিন্তু এর পরও বলতে হবে, মার্কেলের এই বক্তব্য পুরোপুরি সত্য নয়। জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার হিসাব বলছে, এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ৩৮ লাখের বেশি সিরীয় দেশত্যাগ করেছে। এর মধ্যে ১৬ লাখের বেশি আশ্রয় নিয়েছে তুরস্কে। লেবাননে রয়েছে ১১ লাখ ৬৬ হাজার। জর্ডানে ছয় লাখ ২২ হাজার। ইরাকে আছে দুই লাখ ৩৫ হাজার। মিসরে আছে এক লাখ ৩৬ হাজার। বাকিরা বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে।
মনে রাখতে হবে, সিরিয়া সেই দেশ, যে দেশটি মাত্র কিছু দিন আগে ১৮ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল। পশ্চিমা দেশগুলো ইরাক আক্রমণের পর ১৩ লাখ ইরাকি শরণার্থী সিরিয়ায় আশ্রয় নিয়েছিল আর সাড়ে পাঁচ লাখ ফিলিস্তিনিকে তারা আগে থেকেই আশ্রয় দিয়েছিল। নিয়তির নির্মম পরিহাস হচ্ছে, এখন সিরিয়ার এই মানুষেরা শরণার্থী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। শুধু আরব দেশগুলো নয়, পাকিস্তানও দশকের পর দশক ধরে ৪০ লাখ আফগান শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে আসছে। কিন্তু শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার গল্প পশ্চিমা গণমাধ্যমে কখনোই দেখা যায়নি।
বাস্তবতা হচ্ছে, শরণার্থী তৈরির কারিগর হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানিসহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ইহুদিদের বিতাড়িত করার দৃশ্যের সাথে এখনকার শরণার্থীদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। জন্মভূমি হারিয়ে একটি ব্যাগ আর স্ত্রী-সন্তানকে কাঁধে নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে শত শত মাইল হেঁটে আরব সন্তানেরা পূর্ব ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এভাবে পূর্ব ইউরোপ আর জার্মানি থেকে ইহুদিরা পালিয়ে দুনিয়ার নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে আরবদের ওপর। আরব ভূখণ্ড দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্রের সৃষ্টি করা হয়। এর বোঝা এখন আরবদেরই বহন করতে হচ্ছে। এখন আরবেরা আবার আশ্রয় নিচ্ছে পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।
সিরিয়া, ইরাক আর লিবিয়ায় যদি যুদ্ধ না হতো তাহলে এসব মানুষকে এক কাপড়ে এভাবে দেশান্তরী হতে হতো না। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান বলেছেন, এই শরণার্থীদের দায় পশ্চিমা বিশ্বকে নিতে হবে। সিএনএনের সাথে সাক্ষাৎকারে এরদোগান বুঝেশুনেই যে এই মন্তব্য করেছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি জানেন, পশ্চিমা বিশ্ব কেন এবং কোন উদ্দেশ্যে যুদ্ধের নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে, আর কেনই বা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার এই প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
সিরিয়ায় আজকের এই পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রধান কারণ হচ্ছে, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর একনায়কত্ববাদী শাসন। সিরিয়ায় বছরের পর বছর ধরে বাশার আল আসাদ আর তার পিতা হাফেজ আল আসাদ দেশটি শাসন করে আসছেন। এই দেশের ৭৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী সুন্নি মুসলিম। ১৩ শতাংশ শিয়া আর ১০ শতাংশ খ্রিষ্টান। কিন্তু দেশ চালাচ্ছে শিয়া জনগোষ্ঠী। বিশেষ করে আলাভি শিয়া জনগোষ্ঠী দেশটির গুরুত্বপূর্ণ সব পদ দখল করে আছে। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের শাসনের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ বহু বছর ধরে ছিল। তথাকথিত আরব বসন্তের আড়ালে সিরিয়ায় যখন অস্থিরতা সৃষ্টি হয় তখন পশ্চিমা বিশ্ব দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ করে। সাদ্দাম বা গাদ্দাফি সরকারকে যেভাবে পশ্চিমারা উৎখাত করেছে, আসাদের ক্ষেত্রে সে পথে পশ্চিমারা যায়নি। সৌদি আরব আর তুরস্কের আশা ছিল, আসাদ সরকারকে উৎখাত করে সেখানে একটি নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব সৌদি-তুরস্ক পরিকল্পনায় মুখে সমর্থন দিলেও বাস্তবে বিভাজনের নিজস্ব পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে গেছে। এর অংশ হিসেবে নানা সশস্ত্র গ্রুপকে অস্ত্র সরবরাহ করে দেশটি কয়েক ভাগে বিভক্ত করা হয়। ইরাক থেকে আইএসের প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয় সিরিয়া। মাঝখানে তুরস্ককে শরণার্থীর বোঝা বহন করতে হচ্ছে। কিন্তু দামেস্কসহ কয়েকটি প্রদেশে বাশার আল আসাদ তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে রেখেছেন। আসাদ সরকারের শিগগিরই পতন হবে, এমন আশা আর কেউ করে না; বরং আসাদ সরকারের সাথে পশ্চিমা বিশ্বের আলোচনার চেষ্টা চলছে।
এর মধ্যে ইরানের সাথে পশ্চিমা দেশগুলোর বোঝাপড়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি বদলে যায়। শিয়া-সুন্নি বিভাজন আবার নতুন করে সামনে চলে এসেছে। ইরান, সিরিয়া লেবানন নতুন শিয়া শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলো এখন বিপদাপন্ন হয়ে পড়ছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম পড়ে গেছে। আরব অর্থনীতি এখন হুমকির মুখে। এমন পরিস্থিতিতে সিরিয়ার সুন্নি জনগোষ্ঠী দেশটিতে ফেরার আশা ছেড়ে দিচ্ছে। কারণ, যুদ্ধ থেমে গেলেও তারা আর সিরিয়ায় ফিরতে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। পশ্চিমা দেশগুলো কার্যত এখন ইরান ও সিরিয়ার সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জার্মানি ও ইউরোপে যারা আশ্রয় নিচ্ছে, এরা সবাই সুন্নি মুসলিম। মূলত শরণার্থী আশ্রয়ের মাধ্যমে বাশার আল আসাদের সুন্নিমুক্ত সিরিয়া গঠনের পরিকল্পনাও এগিয়ে যাচ্ছে।
আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত ইউরোপ হঠাৎ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিলেও জঙ্গি ইসলাম নিয়ে অনেকটা নিশ্চুপ। সিরিয়া থেকে যারা এখন ইউরোপে প্রবেশ করছে, তারা সিরিয়ার কোন অঞ্চল থেকে আসছে, সে প্রশ্ন কেউ করছে না। এসব মুসলমান জিহাদি হবে কি না, সে প্রশ্ন আর উঠছে না। এরা কী আইএস প্রভাবাধীন এলাকা থেকে এসেছে? এদের কারো কি অস্ত্রের প্রশিক্ষণ আছে, সেসব বিষয় এখন সামনে আনা হচ্ছে না। তাহলে আইএস কার তৈরি? আইএসের ক্ষমতা, প্রভাব ও শক্তিমত্তা নিয়ে এত দিনের প্রচারণা কি মিথ্যা। নাকি সবই সাজানো?
এর মধ্যে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান আশঙ্কা করেছেন, মুসলিম অভিবাসীরা খ্রিষ্টান শিকড়ের জন্য হুমকি। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে অটোমান শাসনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেছেন, আমরা এ ধরনের ফলাফল চাই না। হাঙ্গেরির ভয় অন্যখানে। পূর্ব ইউরোপে অটোমান সাম্রাজ্য বিস্তারে প্রধান বাধা ছিল হাঙ্গেরি। মেসোডেনিয়া, বুলগেরিয়া ও সার্বিয়া অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে আসার পর হাঙ্গেরিতে একাধিকবার বড় ধরনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের সময় (১৪২৯-৫১) ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। হাঙ্গেরীয়দের জাতীয় বীর হুনিয়াদির নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপের খ্রিষ্টান রাষ্ট্রগুলো ঐক্যবদ্ধ হয় এবং অটোমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে। এই যুদ্ধ দীর্ঘ সময় চলে। দ্বিতীয় মুরাদের বাহিনী পরাজিত হলে দ্বিতীয় মুহাম্মদ অল্প সময়ের জন্য সুলতান হওয়ার পর হুনিয়াদিকে পরাজিত করেন। মহামতি সুলতান সুলায়মান (১৫২০-৬৬) হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে দুইবার যুদ্ধাভিযান করেন। এই যুদ্ধে সম্রাট দ্বিতীয় লুই আটজন বিশপসহ ২৪ হাজার সেনা সদস্য মারা যায়। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডে হাঙ্গেরি খ্রিষ্টান জগৎকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছে।
ভিক্টর ওরবানের মনে আবার সেই ভয় জেগে উঠেছে। ইউরোপে তুর্কি ও সিরিয়ানদের প্রভাব বাড়ার শঙ্কায় আছেন তিনি। শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ায় জার্মানির সমালোচনা করছেন ওরবান। কিন্তু তার সাথে ইউরোপের অন্য শাসকেরা এই মুহূর্তে একমত হবেন না। কারণ, অর্থনীতি ও জনবলের চাহিদা। ওরবান একটি বিষয় আবারো সামনে এনেছেন, তা হলো শেষ বিচারে ধর্মীয় পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মার্কেল মক্কা আর মুসলমানের পরিচয় সামনে এনেছেন। বসনিয়ার যুদ্ধে মুসলমান পরিচয়ের কারণে নিধন অভিযান চালানো হয়েছে।
অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারণে এখন ক্রুসেডীয় মনোবৃত্তি আড়াল করা হচ্ছে। প্রয়োজনে আবার সামনে আনা হবে। মাত্র কিছু দিন আগে ইসলামকে বর্বর হিসেবে পশ্চিমা গণমাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইউরোপ এখন মুসলমান শরণার্থীদের আশ্রয়ের নামে মানবতার যে জয়গান গেয়ে চলছে, তা একান্তই অর্থনৈতিক। পোপ প্রতিটি চার্চে একটি করে পরিবার আশ্রয় দেয়ার কথা বলেছেন। এর পেছনে শরণার্থীর অর্থনীতি। জার্মানির মতো শিল্পোন্নত দেশ জন্মহারের নিম্নগামিতার কারণে জনসংখ্যা ঘাটতির সঙ্কটে পড়েছে।
সিরিয়া থেকে যে শরণার্থীরা জার্মানি বা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে, এদের প্রায় সবাই শিক্ষিত ও আধুনিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত। একই সাথে এদের বিরাট একটি অংশ কর্মক্ষম তরুণ। জার্মানির ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিতে তরুণ জনগোষ্ঠীর ঘাটতি এরাই পূরণ করতে পারবে। জার্মান অর্থনীতিতে বিদেশী নাগরিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে তুর্কিরা। ১৫ লাখের বেশি তুরস্কের নাগরিক এখন জার্মানিতে বসবাস করছে। তুর্কিদের সাথে সিরিয়ানদের যথেষ্ট মিল রয়েছে। এরাই জার্মান অর্থনীতিকে আগামী দিনে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। টিকে থাকার জন্য শরণার্থীরা হয় উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী আর একই সাথে শ্রম সস্তা। জার্মানী ইউরোপের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি হলেও এখন যথেষ্ট পরিমাণ উৎপাদন করতে পারছে না।
জার্মানির পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্য বলছে, ২০১৪ সালে দেশটির জনসংখ্যা ছিল আট কোটি ১১ লাখ। এই সংখ্যা কমছে এবং এটা থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিলেও জনসংখ্যার এই হার আগামী কয়েক বছর সামান্য পরিমাণে বাড়তে পারে। এর পরই সেটা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। ২০৬০ সাল নাগাদ জার্মানির জনসংখ্যা দাঁড়াবে ছয় কোটি ৮০ লাখ থেকে সাত কোটি ৩০ লাখের মধ্যে। আজকের জনসংখ্যা থেকে সেটা হবে ৮০ লাখ থেকে এক কোটি ৩০ লাখ কম।
এই পরিণতি জার্মানির কর্মক্ষম জনশক্তির সংখ্যাও কমিয়ে দেবে। ২০৬০ সাল নাগাদ ২০ থেকে ৬৪ বছর বয়সী জার্মান নাগরিকের সংখ্যা ৬০ শতাংশ থেকে কমে ৫০ শতাংশে নেমে আসবে। সাম্প্রতিককালের অভিবাসীদের সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও জার্মানির জন্মহারের যে ঘাটতি, সেটা পূরণ করতে পারছে না তারা। এই সমস্যা এখন পুরো ইউরোপেই বিরাজ করছে।
জার্মানির এমপ্লয়ার ফেডারেশন বিডিএ’র হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে এক লাখ ৪০ হাজার ইঞ্জিনিয়ার, প্রোগ্রামার ও টেকনিশিয়ানের ঘাটতি রয়েছে। দেশটির স্বাস্থ্য খাত জনসংখ্যার অভাবে সঙ্কটের মুখে রয়েছে। জার্মানির একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, ২০২০ সালে দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি ১৮ লাখে দাঁড়াবে। পশ্চিমা দেশগুলো একেবারেই প্রয়োজনের তাগিদে শরণার্থীদের আশ্রয় দিচ্ছে।
পশ্চিমা বিশ্ব শরণার্থী সৃষ্টির এই কৌশল বিভিন্ন সময় প্রয়োগ করেছে। পুরো মধ্যপ্রাচ্য এখন যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। আগামী দিনগুলোর পরিস্থিতি আরো যে ভয়ঙ্কর হবে তা বলা বাহুল্য। বদলে যাবে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র। সিরিয়া ও ইরাক ভূখণ্ডগত দিক দিয়ে আলাদা হয়ে পড়ছে। তুরস্ক চাইছে, সে দেশে আশ্রয় নেয়া সিরিয়ার নাগরিকদের জন্য আলাদা এলাকা। শরণার্থী সৃষ্টি ও আশ্রয় সবই হচ্ছে বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। বাংলাদেশে আয়লান কুর্দির ছবি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ঝড় উঠেছে। সংবাদপত্রে বিশাল ছবি আর বিশ্লেষণ ছাপা হচ্ছে। পশ্চিমা গণমাধ্যম যেভাবে আমাদের চিন্তা করতে শেখায় আমরা সেভাবে চিন্তা করছি। কেন আয়লানরা শরণার্থী হয় তা আমরা ভেবে দেখি না। জনসমর্থনহীন সংখ্যালঘু একটি সরকারের নিপীড়নমূলক শাসন একটি দেশকে কিভাবে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়, সিরিয়া তার উদাহরণ। আমাদের এমন পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
0 Reviews:
Post Your Review